ট্রিপল মার্ডার: মা-মেয়ের এক প্রেমিক, শ্যালিকা-দুলাভাইয়ের পরকীয়া
- আপডেট সময় : ০৭:৫১:৩০ অপরাহ্ন, সোমবার, ২১ জুন ২০২১ ১২৫ বার পড়া হয়েছে
রাজধানীর কদমতলীতে ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় এবার চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। পরকীয়া, সম্পত্তির ভাগভাটোয়ারা ও অনৈতিক কাজ- এই তিনটি কারণে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে জানা গেছে। তবে অন্য কোনো কারণ রয়েছে কিনা তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের অনুসন্ধান চলছে।
বিভিন্ন সূত্রের দাবি, মৌসুমী ইসলামের (৪০) স্বামী মাসুদ রানা (৫০) প্রায় ২৫ বছর মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন। তিন মাস আগে তিনি দেশে ফেরেন। স্বামী প্রবাসে থাকার সময়ে মৌসুমী অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। কয়েকজন যৌনকর্মীকে দিয়ে তিনি দীর্ঘদিন অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়েছেন।
এমনকি নিজের দুই মেয়েকেও দিয়ে দেহ ব্যবসা করাতেন তিনি। এক সময় তার কথিত প্রেমিকের সঙ্গে বড় মেয়ে মেহজাবিন ইসলাম মুনের বিশেষ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের অন্তরঙ্গ অবস্থার একটি ভিডিওচিত্র পরিবারের কেউ ধারণ করে রেখেছিলেন।
বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার ব্যক্তিগত সচিব আমিনের সঙ্গে মেহজাবিনের প্রেমের সম্পর্ক ছিল বলে জানা গেছে। এতে আপত্তি ছিল পরিবারের। মৌসুমী এ ব্যাপারে জানার পর মেয়েকে একরকম জোর করেই শফিকুল ইসলামের সঙ্গে বিয়ে দেন।
মেহজাবিনের খালা ইয়াসমিন বলেন, পাঁচ বছর আগে পারিবারিকভাবেই শফিকুল ও মেহজাবিনের বিয়ে হয়। এর কিছুদিন পরই মেহজাবিনের আগের সম্পর্ক নিয়ে দাম্পত্য কলহের সৃষ্টি হয়। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় আমিনকে হত্যা করেন শফিকুল। এর আগে তিনি শাশুড়ি মৌসুমী ও খালাশাশুড়ি শিউলিকে দিয়ে আমিনকে ডেকে নেন। এ কারণে হত্যা মামলায় ওই দুজন ও মেহজাবিনকে আসামি করা হয়।
তিনি বলেন, এ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ছয় মাস কারাগারে থাকার পর জামিন পান শফিকুল। পরে মেহজাবিনের ছোট বোন জান্নাতুলের (২০) ওপর নজর পড়ে তার। তিনি নানাভাবে উত্ত্যক্ত করতে থাকেন। বিষয়টি নিয়ে একপর্যায়ে জামাতার বিরুদ্ধে মামলা করেন মৌসুমী। আবার তার বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করেন জামাতা।
ইয়াসমিন বলেন, শফিকের সঙ্গে আমার বোন পেরে উঠতে না পেরে তার ছোট মেয়ে জান্নাতুল ইসলামকে (শফিকের শালিকে) কারাগারে দিয়ে দেন। শফিক তদবির করে ৫ মাস পর তাকে কারাগার থেকে বের করে নিয়ে এসে আবার তার সঙ্গে অনৈতিক কাজ করেন।
‘এ নিয়ে আমার ভাগ্নি ও বোনের সঙ্গে শফিকের কলহ লেগেই থাকত। ৪ বছর আগে শফিক আমার বোনকে (তার শাশুড়ি) হত্যার উদ্দেশ্যে গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। চিকিৎসা করতেও বাধা দেয়। দরজা-জানালা বন্ধ করে আমার বোন ও ভাগ্নিকে প্রায়ই মারধর করত। এ বিষয়ে কদমতলী থানায় অভিযোগ জানিয়ে কোনো ফল না পেয়ে কোর্টে মামলাও করা হয়েছে।’
ইয়াসমিনের অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবেই শফিকুল এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। তিনি একজন ঠান্ডা মাথার খুনি। এ ঘটনায় তিনি স্ত্রীকে জিম্মি করে হত্যায় সহায়তা করতে বাধ্য করেছেন। নইলে তাদের শিশুসন্তান তৃপ্তিকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছেন।
একা তিনজনকে হত্যা করা সম্ভব নয় বলেই তিনি স্ত্রীকে কাজে লাগিয়েছেন। তাকে বোঝানো হয়েছে, চলমান অশান্তি নিরসনে এটাই কার্যকর পন্থা। আর ঘটনার পর তিনি মুনকে বুঝিয়েছেন, তুমি পুলিশে ফোন করে হত্যার দায় স্বীকার করো। কয়েকদিন পর আমি তোমার জামিনের ব্যবস্থা করব।
ঘাতকের চাচাতো বোন পরিচয় দেওয়া শিলা বলেন, গত দুদিন আগে স্বামী-সন্তানকে নিয়ে মায়ের বাড়িতে বেড়াতে আসে মেহজাবিন। এসেই তার ছোট বোন জান্নাতুলের সঙ্গে তার স্বামীর পরকীয়া রয়েছে বলে বাবা-মাকে অভিযোগ করে।
এ নিয়ে অনেক কথা কাটাকাটি হয়। তার জেরেই হয়তো এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, মেহজাবীন তার পরিবারের সবাইকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল। সে তার আগের ঘরের স্বামীকেও খুন করেছিল। তার আগে বিয়ে হয়েছিল দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জে। সেই মামলায় মেহজাবিনসহ তার নিহত বাবা-মা ও বোনের জেল হয়েছিল। পাঁচ বছর জেল খেটে তারা জামিনে ছাড়া পায়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শফিকুল দাবি করেন, তার স্ত্রী মেহজাবিন অনেকদিন ধরেই উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করে আসছিলেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কলহ হতো। মা-বাবার সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো ছিল না তার স্ত্রীর। শুক্রবার তাকে ও মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়িতে যান মেহজাবিন। সেখানে রাতে তিনি সবাইকে নানারকম খাবার খেতে দেন। ওই খাবারে সম্ভবত কিছু মেশানো ছিল, কারণ খাওয়ার কিছুক্ষণ পরই তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। এরপর কী ঘটেছে কিছুই তার জানা নেই।
ডিএমপির ওয়ারি বিভাগের উপকমিশনার শাহ ইফতেখার আহমেদ বলেন, মেহজাবিনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, বাবা না থাকায় তার মা তাকে এবং তার ছোট বোনকে (নিহত জান্নাতুল) দিয়ে দেহ ব্যবসা করাত। এসব নিয়ে প্রতিবাদও করেছিল সে, কিন্তু কোনো ফল হয়নি। তার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর ছোট বোনকে দিয়ে ব্যবসা চলছিল। এর মধ্যে তার স্বামী ছোট বোনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে।
এছাড়া মেহজাবিনের বাবা মাসুদ রানা ওমানে আরেকটি বিয়ে করেছেন। এসব মিলিয়ে দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ থেকে পরিবারের সবাইকে হত্যার পরিকল্পনা করেন বলে মেহজাবিন পুলিশকে জানিয়েছেন।
এছাড়া প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, জায়গা সম্পত্তি নিয়েও পরিবারের সঙ্গে বিরোধ ছিলো মেহজাবীনের। সম্পত্তি লিখে দেয়ার জন্য বাবা-মাকে অনেক চাপ দিতো। এ নিয়ে এর আগে বৈঠক সালিশ হয়েছে।
পুলিশ বলছে, মেহজাবীন তার বাবা-মা ও বোনকে হত্যা করে ৯৯৯-এ কল করে। এ সময় তিনি বলেন, আপনার দ্রুত না আসলে আমার স্বামী ও মেয়েকে খুন করে ফেলব। পরে দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশ নিহত তিনজনের লাশ উদ্ধার করে। অন্য দুজনকে অচেতন অবস্থায় ঢামেকে পাঠায়।
পুলিশের ধারণা, শুক্রবার (১৮ জুন) রাতে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাইয়ে তিনজনকে গলায় ফাঁস দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।
ওসি জামাল উদ্দিন বলেন, আমরা মরদেহগুলো হাত পা বাঁধা অবস্থায় পেয়েছি। শুক্রবার রাতে তাদের হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করেছে তাদেরই আরেক মেয়ে। সেই মেয়েকে আটক করা হয়েছে।
কদমতলী থানার ওসি জামাল উদ্দিন মীর বলেন, মেহজাবিনের স্বামীকেও আমরা সন্দেহের বাইরে রাখছি না। তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সম্পত্তির বিষয়ও এখানে রয়েছে। তদন্তে এসব আসবে।
প্রসঙ্গত, শনিবার (১৯ জুন) সকালে রাজধানীর কদমতলীর জুরাইনের মুরাদপুরে একটি ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে মাসুদ রানা , তার স্ত্রী মৌসুমী ইসলাম ও মেয়ে জান্নাতুলের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। অচেতন অবস্থায় মেয়ের জামাই শফিকুল ইসলাম ও নাতনি তৃপ্তিকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় ওই পরিবারের বড় বোন মেহজাবিন ইসলাম মুনকে গ্রেপ্তার করা হয়।