ঢাকা ১২:৫১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দ্যা ট্রাভেলার

তানভীর ওয়াহিদ রবিন
  • আপডেট সময় : ০৪:০৩:১৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই ২০২৪ ৪৭ বার পড়া হয়েছে
আজকের জার্নাল অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

বন্ধু সায়েমের সপ্তাহখানেকের জন্য ভূটানযাত্রার খবর শুনে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো। নাহ্! বন্ধুর সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হওয়ার দুঃখে মন খারাপ হয়নি। মন খারাপ হয়েছে, বন্ধুর প্রতি ঈর্ষার কারণে। যদিও অন্যের প্রতি হিংসাত্মক মনোভাব পোষণ করা আমার চরিত্রের অংশ নয়। কিন্তু আজ আমার এই সহজ, সরল বন্ধুটির প্রতি আমার বেশ হিংসা হচ্ছে। সায়েম যখন ফোনালাপে আমাকে তার ভূটান ভ্রমণের আগাম খবরটা দিল, তখন হাসিমুখে তাকে “কনগ্রাচুলেশন” জানালেও আমার ভেতরে ততক্ষণে জ্বলুনি শুরু হয়ে গিয়েছে। কি কপাল নিয়ে জন্মেছিস রে শালা! ছুটি কাটাতে স্বপরিবারে দেশের বাইরে ভ্রমণে যাচ্ছিস। ভূটানের মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক শোভার নির্যাস উপভোগ করে, ভিন্ন জীবনধারা আর সংস্কৃতির জ্ঞান লাভ করে আর বিশুদ্ধ জলবায়ু সেবন করে মনটাকে তরতাজা করে দেশে ফিরবি। আর আমাকে কিনা এই গরম, যানজট, ধুলোবালিতে ছেয়ে যাওয়া ঢাকা শহরে পচে মরতে হচ্ছে! হ্যাঁ! সায়েমের প্রতি আমার হিংসার এই একটাই কারণ। সেটা হচ্ছে, ভ্রমণ। সায়েমের মত আমারও দেশ বিদেশ ভ্রমণের শখ। শুধু শখ বললে ভুল হবে, সেটা আমার নেশা; স্বপ্নও বলা যায়। সায়েমের মত আমিও স্বপ্ন দেখি একজন পর্যটক হবার। স্বপ্ন দেখি, পৃথিবীর পথে প্রান্তরে চড়ে বেড়াবার । নানান দেশের নানান সংস্কৃতির মানুষের সাথে মিশে যাওয়ার । সঙ্গে থাকবে একটা ক্যামেরা আর আমার প্রিয় অ্যাকুইস্টিক গিটার। সেই ক্যামেরায় বন্দী করে রাখব আমার পছন্দের স্থান আর প্রিয় মুহুর্তগুলোকে। গিটার বাজিয়ে গান শোনাব দেশ বিদেশের ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েদের। কিন্তু সেটা এখন পর্যন্ত স্বপ্নই থেকে গেলো। সায়েমের মত স্বপ্নটাকে আমি বাস্তবে রূপ দিতে পারছি না। আমার দৌড় কক্সবাজার কি বান্দরবান পর্যন্তই। তাও সেটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ট্যুর মারফৎ। নিজ দেশের গন্ডি পেরোনোর সাধ্য এখনও আমার হয়ে উঠেনি। কারণ, সায়েমের মত বিত্তশালী পরিবারের সন্তান আমি নই। আমার জন্ম একটি খাস মধ্যবিত্ত পরিবারে। এদেশের আর দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতই “সাধ আছে, কিন্তু সাধ্য নেই” নীতির উপর ভর করেই চলছে আমার পরিবার। যে পরিবারে মাসের শেষ দিনগুলোতে বাবার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। ছেলেমেয়েরা তাদের শখ আহ্লাদের কথা মুখ ফুটে তাদের বাবার কাছে বলতে পারে না। মায়েরা সংসারের জন্য তাদের সমস্ত আরাম আয়েশ বিসর্জন দেন। আজকের দিনে সেরকম একটি পরিবারের সন্তান হয়ে “পর্যটক” হবার স্বপ্নটা কেবল স্বপ্নই নয়, দুঃস্বপ্নও বটে!
ছোটবেলা থেকেই নানান জায়গায় ছুটে বেড়ানোর বদঅভ্যাস(!) ছিল আমার। প্রায়ই স্কুল ফাঁকি দিয়ে বেকবেঞ্চার বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে বেড়িয়ে পড়তাম। কখনো চলে যেতাম, মাইজখাপন ইউনিয়নের কাচারীপাড়া গ্রামের ভেতর বয়ে যাওয়া ফুলেশ্বর নদীর তীরে, কখনো বা কাদিরজঙ্গল ইউনিয়নের জঙ্গলবাড়িতে। স্কুল জীবনের সেই ঘুরে বেড়ানোর বদঅভ্যাসটাই আমাকে পর্যটক হবার জন্য অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবনেও সেই ভ্রমনের পাগলামিটা দূর হয়নি। এখনও সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ি এখানে সেখানে। আমার একগুঁয়ে বহির্মুখী স্বভাবের কারণে বাবা-মা সবসময়ই আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগেন। ছোটবেলায় তার জন্য কম শাসন হজম করতে হয়নি আমাকে। শাসনের সঙ্গে সঙ্গে চলত মোটিভেশনাল স্পীচ। “আগে মন দিয়ে লেখাপড়া কর। ভালো রেজাল্ট করে এস্টাবলিস্ট হও। তারপর তুমি তোমার ইচ্ছামতো দেশ বিদেশ ভ্রমণ করতে পারবে।” শৈশব থেকেই এই আশ্বাসবাণীটা হোমিওপ্যাথি ওষুধের মত সকাল সন্ধ্যা আমাকে গেলানো হচ্ছে। আমিও গিলেই চলেছি। দেখি ভবিষ্যতে কি হয়!
তবে, শুধুমাত্র অনুপ্রেরণামূলক বাণী গিলেই দমে যাওয়ার পাত্র আমি নই। শৈশবের মত এখন হয়তো এতোটা দুরন্তপনায় মেতে উঠতে পারি না। তবে আমার ভ্রমন কিন্তু থেমে নেই। বরং দিন দিন আমার ভ্রমণের সীমা পরিসীমা বেড়েই চলেছে। আমি আমার মত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে দুরন্তবেগে ছুটোছুটি করে চলেছি। সায়েমের চেয়েও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জায়গায় পদচারণ করি। ফ্রম সুমাত্রা টু সুমেরু। প্রশ্ন জাগতে পারে, সেটা কি করে সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর সত্যজিৎ রায় তার অবিস্মরণীয় সৃষ্ট চরিত্র লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ুর মাধ্যমে দিয়ে গেছেন।
“কল্পনার দৌড় থাকলে শুধু প্লেনে কেন? রকেটে করে চাঁদে পর্যন্ত যাওয়া যায়”
জটায়ুর মত আমার কল্পনার দৌড়টাও নেহাৎ কম নয়। সৃষ্টিকর্তা আমাকে এই একটি জিনিস একেবারে ঢেলে দিয়েছেন, “কল্পনা শক্তি”। তুখোড় কল্পনাশক্তি আমার। সেই কল্পনাশক্তির জোরে আমি যখন তখন যেখানে খুশি সেখানে চলে যেতে পারি। দৈনন্দিন দায়িত্ব-কর্তব্যের ফাঁক-ফোকরে যখন গল্প-উপন্যাস কিংবা ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে বসি, তখন আমি হারিয়ে যাই গল্পের প্লটের ভেতর। প্রেক্ষাপট অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ যাইহোক না কেন আমি সেই প্রেক্ষাপটকে একেবারে জীবন্তরূপে দাঁড় করাতে পারি আমার কল্পনায় । প্লটের বর্ণনা অনুসারে আমার কল্পনার ক্যানভাসে জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠতে থাকে দেশ বিদেশের নানা শহরের অলিগলি, রাস্তাঘাট। আমি পরিষ্কার দেখতে পাই নিউইয়র্কের ব্যাস্ত রাস্তাঘাট কিংবা প্যারিসের সুপ্রশস্ত রাজপথ। কখনো তপ্ত সাহারায়, কখনো বৃষ্টিভেজা অ্যামাজান বনে আমি হেঁটে বেড়াই। চোখে পড়ে নানান রকমের চেনা অচেনা গাছপালা, ফুল-ফল। আমি তার রূপ, গন্ধ, স্বাদ অনুভব করতে পারি। কখনো কখনো গল্প উপন্যাসের কিংবদন্তীদের সাথেও আমার সাক্ষাৎ হয়ে যায়। লন্ডনের ২২১ বেকার স্ট্রীটে বিচরণ করতে যেয়ে সাক্ষাৎ হয়ে যায় গায়ে ওভারকোট জড়ানো, ছয়ফুট লম্বা, খাঁড়া নাকের শার্লক হোমসের সাথে। কখনোবা কোন নির্জন দ্বীপে মুখভর্তি দাঁড়ি-গোঁফওয়ালা রবিনসন ক্রুশোর সাথে আমার দেখা হয়ে যায়। কখনো কখনো আমি আমার বাংলাদেশটাকেই নিজের মত করে দেখি। সেই বাংলাদেশ অপরিকল্পনা আর অসচেতনার বলি নোংরা, ঘিঞ্জি, অর্ধমৃত বাংলাদেশ নয়। সেই বাংলাদেশ অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, অনেক বেশি স্নিগ্ধ, প্রাণবন্ত। সেখানে বুড়িগঙ্গায় বয়ে যায় নোংরা-আবর্জনাহীন স্বচ্ছ টলমলে পানি। আমার কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা নদী তার প্রাণ ফিরে পায়। সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র্য তার হারানো জৌলুশ ফিরে পায়। সুন্দরবন জুড়ে মোটাতাজা রয়েল বেঙ্গল টাইগাররা সুখে শান্তিতে বসবাস করে। প্রতিবেশি দেশের আগ্রাসন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত আমার কল্পনার সেই বাংলাদেশ।
কিন্তু, কল্পনায় কি সব হয়? কোনকিছু নিজ চোখে দেখার মাঝে যে তৃপ্তি সেই তৃপ্তি কি কল্পনায় দেখে পাওয়া যায় ? যায় না। যায় না বলেই কল্পনা থেকে যখন বাস্তবে ফিরে আসি, তখন মনটা আক্ষেপে ভরে যায়। বিষণ্ণ মনে ভাবতে থাকি, নিজের কথা, নিজের পরিবারের কথা। কি এমন ক্ষতি হয়ে যেতো, যদি আমার পরিবার আরেকটু ধনী হতো। কি এমন ক্ষতি হতো, যদি আমার পর্যটক হবার স্বপ্নটাকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতাম। অবুঝ শিশুর মত অভিমান জাগে সৃষ্টিকর্তার প্রতি। সেই অভিমান নিয়ে আমি ভাবতে থাকি ভ্রমণকাহিনীর লেখকদের কথা। ভ্রমণবিষয়ক অনুষ্ঠানের উপস্থাপকদের কথা। পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটোছুটি করে তারা তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারি করছে। হাজার রকমের সংস্কৃতির হাজার রকমের নির্যাসে নিজেদের হৃদয় পূর্ণ করছে। আহ! কতই না সুখে আছে তারা।
আমার বিছানার পাশে একটা ম্যাগাজিন পড়ে আছে। ভ্রমণবিষয়ক ম্যাগাজিন। নাম, “টেক্সাস হাইওয়েজ”। তবে জিনিসটি আমার নয়। আমার বন্ধু রবিনের। ভুলে আমার এখানে ম্যাগাজিনটি ফেলে চলে গেছে। আড্ডা দিতে এসে প্রায়ই সে ভুল করে এটা সেটা ফেলে রেখে চলে যায়। আমি ম্যাগাজিনটি হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলাম। ঝকঝকে রঙিন ছবিসহ ভ্রমণবিষয়ক নানান আর্টিকেল লেখা। ইচ্ছা করছে, এখনই পড়ে শেষ করে ফেলতে। কিন্তু এই মুর্হুতে সেটা সম্ভব নয়। ভার্সিটিতে যেতে হবে। ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরে এসে পড়া যাবে। আমি চটপট তৈরি হয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
ভার্সিটিতে চরম বিরক্তিকর একটা সময় কাটল । কোন ক্লাসেই মন বসাতে পারলাম না। টিচারদের লেকচার সব মাথার উপর দিয়ে গেলো। লেকচারের বিষয়বস্তু কিছুই বুঝিনি । বোঝার চেষ্টাও করিনি। ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিতে চাইলাম। আড্ডা জমলো না। এমনকি সিনেমার জোকারদের মত কাতুকুতু দিয়েও আড্ডা জমানো গেলো না। উল্টো বিরক্তি বাড়ল। অবশেষে আড্ডায় ইস্তফা দিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে বনানী বাসস্টপেজে এসে পৌঁছলাম। এখন কেবল বাসের জন্য অপেক্ষা।
ইতিমধ্যে আমার চোখের সামনে তিন তিনটা বাস চলে গেলো, কিন্তু প্রচন্ড ভিড়ের কারণে একটি বাসেও উঠতে পারলাম না। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো। এদিকে নীল আকাশকে ঢেকে দেওয়া মেঘের রং ক্রমেই গাঢ় হয়ে উঠছে। ক্ষণে ক্ষণে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম শব্দ জানান দিচ্ছে, যেকোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। সন্ধ্যা নেমে আসতে খুব বেশি দেরী নেই।বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে বাসে উঠতে না পারলে বেশ মুশকিলে পড়ে যাব। অবশেষে অনেক কষ্টে, ঠেলেঠুলে একটা বাসে উঠতে পারলাম। মুড়ির টিন খ্যাত গুলিস্তান টু আজমপুরগামী তিন নাম্বার বাসটি যেভাবে যাত্রীবোঝাই হয়ে আছে, তাতে করে সিট খালি পাওয়ার প্রশ্নই আসে না। কাজেই চাপাচাপি করে দাঁড়িয়ে যেতে হচ্ছে।
কুড়িল বিশ্বরোডে আসতেই শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। বাসের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকায় বাইরের দৃশ্যটা সহজেই দেখতে পারলাম। বেশ জোরেসোরেই বৃষ্টি নেমেছে। অসুবিধা নেই, সামনের স্টপেজেই আমি নেমে যাব। বাস থেকে নেমে কোনমতে একটা চায়ের দোকান বা শপিং মলে আশ্রয় নিতে পারলেই হয়। তারপর না হয় বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। নিকুঞ্জ-২ এ বাস থামতেই আমি দ্রুত বাস থেকে নেমে পড়লাম। তারপর এক দৌড়ে চলে গেলাম রাজউক ট্রেড সেন্টারের পার্কিং লটে। ততক্ষণে আমার শরীরের একাংশ ভিজে গেছে। আমি পাত্তা দিলাম না। এসবে আমার অভ্যাস আছে। আমি পার্কিং লটে পোঁছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। সেখানে আমার মত আরও অনেক হতভাগাই বৃষ্টিতে আটকে গেছে। যাদের কপাল ভালো তারা খালি রিকশা পেয়ে যার যার গন্তব্যে চলে যাচ্ছে। আমি রিকশা খোঁজার চেষ্টা করলাম না। বরং পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে থেকে বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। অপেক্ষাটা মন্দ লাগছে না । বেশ ভালোই লাগছে। এভাবে বর্ষনমুখর সন্ধ্যা উপভোগ করার সুযোগ সবসময় হয় না। আমি একটা সিগারেট ধরালাম। সিগারেট টানতে টানতে বৃষ্টিমুখর শহরের পরিবেশটা উপভোগ করতে লাগলাম। সারাদিনের ধুলোবালি, তপ্ত রোদে জ্বলে যাওয়া শহরটা যেন বৃষ্টির স্পর্শ পেয়ে সতেজ হয়ে উঠেছে। ব্যাস্ত নাগরিক জীবনের ক্লান্তি, অবসাদ সব ধুয়ে মুছে শহরটা হয়ে গেছে ঝলমলে। বৃষ্টি হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার এমন এক দান, যা কিনা ইট-কাঠের ভিড়ে ছেয়ে যাওয়া এই যান্ত্রিক জীবন যাপনের শহরেও স্নিগ্ধতার পরশ বুলিয়ে দেয়। তবে সেই স্নিগ্ধতা সবাই উপভোগ করতে পারে না। সেটা করতে হলে নিজের মনটাকে তৈরী করে নিতে হয়।
ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলো। তবে সড়কবাতিগুলো তখনও জ্বলছে। শপিং মলে চালু করা হয়েছে জেনারেটর। বৃষ্টির বেগ এখনও থামেনি, বরং বেড়েছে। বাতাসের তোড়ে বৃষ্টির ফোটা তেরছা হয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে, আকাশ থেকে কেউ বিশাল একটা স্প্রে মেশিন দিয়ে পানি ছিটিয়ে শহরটাকে ধুয়ে দিচ্ছে। হেডলাইটের আলোতে অন্ধকার ভেদ করে শা শা শব্দে ছুটে চলছে গাড়ি। শহরের সড়কের দু’ধারের অসংখ্য দোকানপাটে বৃষ্টিতে আটকে পড়া লোকজনের ভিড়। রাস্তাঘাটে মানুষজনের চলাফেরা নেই বললেই চলে। সময় আর জীবনের তাগিদে কেউ কেউ রিকশায় করে কিংবা ছাতা মাথায় নিয়ে রাস্তায় বেড়িয়েছে। বর্ষনমুখর শহরের চিরচেনা দৃশ্য। বহু বছর আগে হয়তো এমনই কোন এক বর্ষনমুখর সন্ধ্যায় রবিঠাকুর লিখেছিলেন,
“আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, গেলো রে দিন বয়ে
বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়েরয়ে
একলা বসে ঘরের কোনে কী যে ভাবি আপন মনে
সজল হাওয়া যূথীর বনে কি যায় কয়ে”


হঠাৎ করেই আমার দৃষ্টি পড়ল পার্কিং লটের একদম ডানদিকের কোনায়। খানিকটা চমকে উঠলাম। আমার দৃষ্টি আটকে রইল একটি মেয়ের দিকে। মেয়েটি মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। হ্যাংলা পাতলা স্বাস্থ্য, গড়পড়তা উচ্চতার তুলনায় কিছুটা খাটো, পরনে সাদা শার্টের উপর কালো ব্লেজার, কালো প্যান্ট। বয়সে আমার মতই তেইশ চব্বিশ বছরের মত হবে হয়তো। মেয়েটি আমাদের দেশের নয়, বিদেশিনী। তবে সাদা চামড়ার ইউরোপিয়ান বা আমেরিকান নয়; এশিয়ান। কোন দেশী হতে পারে? চাইনীজ, জাপানীজ নাকি কোরিয়ান? নিশ্চিত হতে না পারলেও তাকে আমার চাইনীজ বলেই মনে হলো। মেয়েটি দেখতে বেশ; সুশ্রী চেহারা। কালো পোশাকে তাকে মানিয়েছে বেশ। আমার দৃষ্টিতে অবশ্য চাইনীজ মেয়েদের সব ধরনের পোশাকেই মানায়। ইউরোপ-আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ মেয়েরা শাড়ি পরলে অদ্ভুত দেখায়। বাঙালি মেয়েরা ওয়েস্টার্ন ফরমাল পোশাক পরলে মনে হয়, কোথায় যেন একটা ঘাটতি আছে। পুরোপুরি মানাচ্ছে না। কিন্তু শুকনা পাতলা চাইনীজ মেয়েগুলো দক্ষিন এশিয়ান বা ওয়েস্টার্ন যে পোশাকই পরুক না কেন, দেখতে বেশ ভালোই লাগে। এই ভালো লাগাটা কি সার্বজনীন নাকি কেবল আমার ব্যাক্তিগত পছন্দ আমি জানি না। তবে যাইহোক না কেন, এই মেয়েটিকে আমার একটু বেশিই ভালো লাগছে। ইচ্ছা করছে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে। কিন্তু মেয়েদের দিকে একটানা তাকিয়ে থাকতে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না বলে আমি মেয়েটির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। কিন্তু চোখ ফিরিয়ে নিতে কেন যেন মনটা সায় দিচ্ছে না। বৃষ্টি দেখায়ও মন দিতে পারছি না। অথচ একটু আগেও তো বৃষ্টিস্নাত শহরের সৌন্দর্য্য মন ভরে উপভোগ করছিলাম, এখন সেভাবে উপভোগ করতে পারছি না। বারবার মনটা কেবল আমার অদূরে দাঁড়ানো নিঃসঙ্গ সেই বিদেশিনীর দিকে চলে যাচ্ছে। একটা দূর্বার আকর্ষন যেন আমাকে মেয়েটির কাছাকাছি নিয়ে চাইছে। কিন্তু সেই আকর্ষনটা কিসের? সুন্দর চেহারা? নাকি অন্যকিছু? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলাম। মনের টানেই হোক কিংবা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্যই হোক, আমি তার দিকে আবার তাকালাম।
একটু আগে আমি ঠিক যেভাবে দু চোখ ভরে বৃষ্টি দেখছিলাম, মেয়েটিকেও দেখলাম ঠিক একই ভঙ্গীতে বৃষ্টি দেখছে। সে বোধহয় বৃষ্টি খুব ভালোবাসে। তার দেশে যখন ঝুম বৃষ্টি নামে, তখনও বোধহয় ঠিক এভাবেই মনপ্রাণ ভরে বৃষ্টির সৌন্দর্য্য উপভোগ করে। মেয়েটি বৃষ্টি দেখায় এতোটাই মগ্ন যে, বৃষ্টির ছাঁট চোখে, মুখে এসে পড়লেও তার মুখভঙ্গীর কোন পরিবর্তন দেখা গেলো না। মাঝে মাঝে দমকা বাতাসের ঝাপটা এসে তার খোলা চুলকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। সেদিকেও তার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। তার মুখভঙ্গি থেকে শুরু করে বৃষ্টিমুখর পরিবেশ, অর্থাৎ পুরো দৃশ্যটা আমার কাছে ছবির মত লাগছে। মনে হচ্ছে, কোন চৈনিক শিল্পী তার সুনিপুন দক্ষ তুলির আঁচড়ে এই বৃষ্টিস্নাত শহরে আটকে পড়া কোন মেয়ের ছবি এঁকেছে।
“এমন দিনে তারে বলা যায়,
এমন ঘনঘোর বরিষায়”
রবি ঠাকুরের এই চরণ দু’টি মনে পড়ছে। তার মত আমারও ইচ্ছা করছে মেয়েটিকে কিছু বলতে । কিন্তু কি বলব? কি বলা যায় তাকে? যেচে গিয়ে কিছু বলতে যাওয়াটা কি ভালো হবে? না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত চেহারার এক অজানা, অচেনা তরুণের যেচে কথা বলতে আসাটা বিদেশী মেয়েটি ভালোভাবে নাও নিতে পারে। ভয় পেতে পারে। নাক চ্যাপ্টা, ছোট চোখের পূর্ব এশিয়ান মানুষগুলো আদব-কায়দার ব্যাপারে খুব রক্ষণশীল হয়।
আমি মনে মনে মেয়েটির একটি নাম দিলাম। লিয়াং। কাছ থেকে দেখব বলে আমি খুব ধীরে ধীরে লিয়াং এর পাশে এসে দাঁড়ালাম। বৃষ্টি দেখায় সে এতোটাই মগ্ন যে আমার উপস্থিতি সে টের পেলো না। তার ছোট ছোট জ্বলজ্বলে চোখ দুটো তাকিয়ে আছে বর্ষনমুখর শহরের রাজপথের দিকে। পাতলা ঠোঁটের কোনায় মৃদু হাসি। বর্ষনমুখর সন্ধ্যার সৌন্দর্যের ভেতর ডুবে গেছে সে। বৃষ্টি দেখতে দেখতে হয়তো ভাবছে তার খুব প্রিয় কোন মুহুর্তের কথা, তার প্রিয়জনের কথা কিংবা শৈশবের কোন সুখস্মৃতি মনে করছে। কি এক অপার্থিব আনন্দে তার চোখে, মুখে এক স্নিগ্ধ আভা ফুটে উঠেছে। সেই শান্ত, কোমল আভায় উজ্জ্বল মুখখানি দেখতে কি যে ভালো লাগছে তা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়। রবি ঠাকুরের মত গোটা বিশেক কবিতা লিখে ফেলা যায়। ইশ! আজকের বৃষ্টি যদি শেষ না হতো! সারারাত যদি তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম!
আমি লিয়াং এর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। জীবনে এই প্রথম কোন মেয়ের দিকে একটানা এভাবে তাকিয়ে থাকা। তার স্নিগ্ধ হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছি। আমার চারপাশটা ক্রমেই বদলে যেতে শুরু করেছে। গাড়িঘোড়ার আওয়াজ ক্রমেই নিচু হয়ে আসছে। সেই সঙ্গে কমছে বৃষ্টির বেগ। পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি আর মানুষগুলো ধীরে ধীরে উধাও হয়ে যাচ্ছে। একটা সময় আমার পাশে দাঁড়ানো লিয়াংও উধাও হয়ে গেলো।

 


আমি হেঁটে চলেছি আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা ধরে। আমার চারধারে চেনা অচেনা নানা রকম গাছপালা, রং বেরঙের লতাগুল্ম। তার সঙ্গে পাখির কিচিরমিচির শব্দ আর দূর থেকে ভেসে আসা আরহু নামক বাদ্যযন্ত্রের সুরেলা আওয়াজ মনটাকে মাতিয়ে তুলছে । আমি খানিকটা সামনে এগিয়ে বাঁক নিতেই পাহাড়ের উপর একটা ছোট আশ্রম দেখতে পেলাম । আশ্রমের মন্দিরটির নাম লিংইন টেম্পল। মন্দিরের দেওয়ালের রং আধুনিক হলেও তার গঠনশৈলী আর নকশা বেশ প্রাচীন। মন্দিরের জানালাগুলো অদ্ভুত আকৃতির; ষড়ভুজাকার। মন্দিরের বারান্দায় একটি ছোট চৈনিক শিশুকে দেখা যাচ্ছে। তার ন্যাড়া মাথা আর ঢিলেঢালা পোশাক দেখে বুঝতে পারলাম সে এই মন্দিরের ছাত্র। কালচে খয়েরি রঙের কাঠের রেলিঙে হাত রেখে উদাস দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে মলিন হয়ে যাওয়া এক বাঘের ভাস্কর্যের দিকে। বাঘের ভাস্কর্যের একটু দূরে বিশাল এক ড্রাগনের মাথার মুর্তি দেখা যাচ্ছে। ড্রাগনের মুখ থেকে অবিরাম পানি ঝরছে। এটি মূলত একটি পানির ফোয়ারা। প্রকৃতি আর কৃত্রিমতার অপুর্ব সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে ফোয়ারাটি। স্থানে স্থানে পাথর কেটে বানানো অদ্ভুত সব মূর্তি, চীনা লোককাহিনীর মাতাল, অলস এবং খামখেয়ালী সাধক জি গং এর ভাস্কর্য। এখানেই সমাধিস্থ করা হয়েছিল তাকে। একটা বিশাল পাথরের কেটলিও দেখা যাচ্ছে। কেটলির নল থেকে চায়ের মত নিচে পড়ছে সরু পানির ধারা । যেন অদৃশ্য কোন মানুষ এক বিশাল কেটলি হাতে পানি ঢালতে ঢালতে বলছে, “ঢেলে দেই?” ভাবতেই খানিকটা হাসি পেলো। তবে ফোয়ারাটি যে কেবল দেখতে মনোমুগ্ধকর তা কিন্তু না। বরং এই ফোয়ারার পানি অত্যন্ত সুমিষ্ট, সুপেয়। খনিজ লবনে সমৃদ্ধ সুপেয় পানির জন্য এই হুপাং ফোয়ারার খ্যাতি আছে। যদিও আমি বৌদ্ধধর্মের অনুসারী না, কিন্তু এই মন্দিরের শান্ত পরিবেশ আর চারপাশের প্রকৃতির নম্রতা আমার হৃদয়ে প্রশান্তির হাওয়া বইয়ে দিল।
এতোক্ষণ এই টাইগার স্প্রিং অর্থাৎ হুপাং ফোয়ারার সামনে আমি ছিলাম একা। কিন্তু এই মুহুর্তে নিজেকে একা মনে হচ্ছে না। আমার ডানপাশে আরেকটি মানবসত্তার অস্তিত্ব টের পাচ্ছি। আমি মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকালাম। আমার খুব কাছাকাছি, একরকম গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে এক চৈনিক তরুণী। মেয়েটির নাম লিয়াং। তার পরনে গাঢ় বেগুনি রঙের চাইনীজ কিমোনো। সুন্দর করে খোঁপা করা চুলে তাকে একেবারে প্রাচীন যুগের চাইনীজ রাজকুমারীর মত লাগছে। লিয়াং আমার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে একটা হাসি দিল। হাসির জবাবে আমি কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। শুধু হা করে তাকিয়ে রইলাম। লিয়াং আমাকে তার সঙ্গে যাওয়ার ইশারা করল। আমিও সম্মোহিতের মত তার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। কোথায় যাচ্ছি জানি না। শুধু জানি যে আমরা উত্তর দিকে যাচ্ছি।
লিয়াং আমাকে নিয়ে গেলো একটি সুবিশাল লেকের তীরে। আমি লিয়াং এর পাশে দাঁড়িয়ে লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। লেকের তীরে চেরিফুল সহ অনেক অজানা ফুলের গাছগাছালি। এখানকার পরিবেশ হুপাং ফোয়ারার পরিবেশের মত এতোটা ছমছমে নয়, বরং অনেক বেশি খোলামেলা আর প্রশস্ত । তবে হুপাং ফোয়ারার মতই আশ্চর্য রকমের শান্ত এবং মনোরম। মনের গভীর থেকে সেই প্রশান্তি অনুভব করা যায়। লেকের ঢেউ খেলানো স্বচ্ছ টলমলে পানির উপর সূর্যাস্তের লাল আলোর ছটা যেন পুরো লেকটিকে জ্বলন্ত অঙ্গারের মত লাল রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। ঐ সুদূর দিগন্ত রেখায় পাহাড়ের সাড়ি লেকের সীমা রেখার জানান দিচ্ছে। লেকের উপর বেশ দূরে একটা সেতু দেখা যাচ্ছে। সেতুর দু’পাশ মসৃণ এবং পানির উপর সমান্তরাল, কেবল মাঝখানটা স্পীডব্রেকারের মত উঁচু হয়ে আছে। এটি ব্রোকেন ব্রিজ নামে পরিচিত। নামটি ব্রোকেন হলেও আদতে এটি ভাঙা নয়। লিয়াং এর কাছ থেকে জানতে পারলাম, এই ব্রীজের আসল সৌন্দর্য দেখা যায় শীতকালে। শীতকালে যখন ব্রিজটি বরফে ঢাকা পড়ে, তখন তাকে সত্যিই ব্রোকেন ব্রিজ বলে মনে হয়।
আমি জানি আমি কোথায় আছি। আমি আছি চীনের হাংঝৌ শহরের ওয়েস্ট লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে । যে লেকে ভ্রমণ করার স্বপ্ন আমি বহুকাল ধরে দেখে এসেছি। বহুবার আমি এখানে এসেছিও। কিন্তু আজকের মত ওয়েস্ট লেক আগে কখনো এতোটা আপন করে নেয়নি আমাকে। তার একমাত্র কারণ হচ্ছে, লিয়াং। এর আগে আমি যতবার আমি এখানে এসেছি, ততবার আমি ছিলাম নিঃসঙ্গ একা। আমার হাতটি ধরার মত কেউ ছিল না। কিন্তু আজ আমি একা নই। আজ আমি আমার ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে পেয়েছি লিয়াংকে। লিয়াংকে সঙ্গী হিসেবে পাওয়ার আনন্দটাই আমাকে ওয়েস্ট লেকের এতো কাছে নিয়ে আসছে। আমার হৃদয় থেকে বহুকালের জমানো দুঃখ, কষ্ট, হতাশার কালিমাগুলো যেন ওয়েস্ট লেকের স্বচ্ছ্ব পানিতে ধুয়ে মুছে যাচ্ছে। লিয়াং আলতো করে আমার হাত স্পর্শ করল। আমি চমকে উঠলাম। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শিহরণ বয়ে গেলো। এই স্পর্শ আমার চেনা। এটা ভালবাসার স্পর্শ। যে স্পর্শের জন্য প্রেমিক হৃদয় ব্যাকুল হয়ে থাকে চিরটাকাল। আমার আর ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না। ইচ্ছা করছে, লিয়াংএর পাশে থেকে জীবনের বাকিটা সময় এই লেকের তীরেই কাটিয়ে দেই।

হঠাৎ গাড়ির হর্নের বিকট আওয়াজে আমি কেঁপে উঠলাম। আমার কল্পনার জাল গেলো ছিন্ন হয়ে। কল্পনার সুদূর ওয়েস্টলেক থেকে ফিরে এলাম বাস্তবে। সেই চিরচেনা রাজউক ট্রেড সেন্টারের পার্কিং লটে। কোথায় সেই লিংইন টেম্পল, কোথায় হুপাই ফোয়ারা? কোথায় সেই ছোট্ট চাইনীজ শিশুটি? কোথায় ওয়েস্ট লেক? আমার চোখের সামনে থেকে মুহুর্তের মধ্যেই উধাও হয়ে গেলো হাংঝৌ শহরের সমস্ত চিহ্ন। শুধু থেকে গেলো তার অনুভূতিটুকু। বিষন্নতায় আমার মনটা ভরে গেলো। মনে হলো নিজের দেশের কথা। ওয়েস্টলেকের যে শান্ত, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ আমি দেখলাম, সেই পরিচ্ছন্নতা তো আমরাও আমাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে পারতাম। কিন্তু আমরা কি আদৌ তা করছি? আমরা কি আমাদের দেশের দৃষ্টিনন্দন স্থানগুলোর সৌন্দর্য বজায় রাখতে পারছি? যত্রতত্র ময়লা, আবর্জনা ফেলে কি দেশের সৌন্দর্যটুকু নষ্ট করছি না? কি অবস্থায় আছে আমাদের সাফারি পার্কের প্রাণীগুলো? কি অবস্থায় আছে ঢাকার বুডিগঙ্গা? সর্বত্রই শুধু অসচেতনা, অবহেলা, দূর্নীতি, রাজনীতি আর প্রতিবেশি দেশের ছল চাতুরী আর আগ্রাসন। সেসবের বলি হতে হচ্ছে আমাদের সুন্দরবনকেও। যে সুন্দরবন ছিল আমাদের গর্ব, যে সুন্দরবন বিশ্বের দরবারে আমাদের দেশকে উপস্থাপন করত; সেই সুন্দরবন দিন দিন তার আবেদন হারাচ্ছে। আবেদন হারাচ্ছে বান্দরবান, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন। বিশ্ব দরবারে নিজেদের উপস্থাপন করার আশায় আজ আমরা সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিজয়িনীদের দিকে তাকিয়ে থাকি। তাকিয়ে থাকি খেলাধূলার দিকে। কিন্তু বহির্বিশ্ব থেকে সুনাম অর্জনের জন্য তো আমাদের এসবের দরকার ছিল না। সুনাম অর্জনের জন্য যথেষ্ট উপাদান প্রকৃতিতেই ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা। সেই উপাদানগুলো আমরা নিজ হাতে নষ্ট করছি। আমাদেরই অবহেলা, অসচেতনার বলি হয়ে আবেদন হারাচ্ছে বাংলাদেশ। ভাবতে ভাবতে আমি লিয়াংএর দিকে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠলাম আমি। লিয়াং আমার দিকে তাকিয়ে আছে! তার ঠোঁটের কোনে সুক্ষ্ণ হাসির রেখা। কল্পনায় লিংইন টেম্পলের সামনে সে যে ভঙ্গীতে আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল, সেই একই ভঙ্গিতে হাসছে। নিজের চোখকে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। এটা কি আমার পাগলাটে মস্তিষ্কের কল্পনা? নাকি বাস্তব? আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বিস্ময়ে আমি এতোটাই নির্বাক হয়ে গিয়েছি যে, তার দিকে কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলাম। এমনকি তার হাসির জবাবে সৌজন্যমূলক পাল্টা হাসি দিতেও ভুলে গেলাম। ঠিক যেমনটা ঘটেছিল আমার কল্পনায়।
অবশেষে বৃষ্টির বেগ কমে আসল। রাস্তাঘাটে বেড়ে গেলো লোকজনের আনাগোনা। পার্কিং লটে অপেক্ষারত লোকজনের অপেক্ষার পালা শেষ হলো। যে যার মত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে নেমে পড়ল রাস্তায়। লিয়াংও আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রাস্তায় নামল। তাকে যেতে দিতে ইচ্ছা করছে না। ইচ্ছা করছে তার হাতটি ধরে আরও কিছুটা সময় আমার পাশে থাকার অনুরোধ করতে। কিন্তু সেটা তো হওয়ার নয়। এটা তো আমার কল্পনার রাজ্য নয়, এটা বাস্তব। এখানে আমরা পরস্পরের কাছে স্রেফ অচেনা, অজানা ভিনদেশী মানুষ ছাড়া আর কিছুই নই। এখানে কেউ কারোর জন্য দায়বদ্ধ নয়। কিন্তু আবেগ তো আমার বাস্তবতার এই কঠিন সত্যকে মানতে পারছে না। সেই আবেগের টানেই আমি লিয়াং এর পিছু পিছু খানিকটা এগিয়ে গেলাম। লিয়াং চলে যাচ্ছে। আমার চোখের সামনে লিয়াং ধীরে ধীরে জনমানবের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে । চিরদিনের জন্য আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে লিয়াং । আর কোনদিন হয়তো দেখা হবে না তার সাথে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। খুব প্রিয় কিছু হারানোর বেদনা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। জীবনে প্রথমবার ভালোবাসা হারানোর পর যে কষ্ট পেয়েছিলাম, সেই একই কষ্ট আলপিনের মত খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমার হৃদয়টাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। কিন্তু কেন? একটা অচেনা, অজানা ভিনদেশি মেয়ের জন্য আমার এতো কষ্ট হচ্ছে কেন? নানান ঘাত প্রতিঘাতে জর্জরিত, পোড় খাওয়া এই পাথরের মত হৃদয়ে একটা অচেনা মানুষের জন্য এতোটা আবেগ জড়ো হবে কেন? এমনটা তো হওয়ার কথা না। তবে কি আমি কল্পনায় লিয়াংকে ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে পেয়ে বাস্তবে তাকে ভালোবেসে ফেলেছি?

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

দ্যা ট্রাভেলার

আপডেট সময় : ০৪:০৩:১৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই ২০২৪

বন্ধু সায়েমের সপ্তাহখানেকের জন্য ভূটানযাত্রার খবর শুনে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো। নাহ্! বন্ধুর সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হওয়ার দুঃখে মন খারাপ হয়নি। মন খারাপ হয়েছে, বন্ধুর প্রতি ঈর্ষার কারণে। যদিও অন্যের প্রতি হিংসাত্মক মনোভাব পোষণ করা আমার চরিত্রের অংশ নয়। কিন্তু আজ আমার এই সহজ, সরল বন্ধুটির প্রতি আমার বেশ হিংসা হচ্ছে। সায়েম যখন ফোনালাপে আমাকে তার ভূটান ভ্রমণের আগাম খবরটা দিল, তখন হাসিমুখে তাকে “কনগ্রাচুলেশন” জানালেও আমার ভেতরে ততক্ষণে জ্বলুনি শুরু হয়ে গিয়েছে। কি কপাল নিয়ে জন্মেছিস রে শালা! ছুটি কাটাতে স্বপরিবারে দেশের বাইরে ভ্রমণে যাচ্ছিস। ভূটানের মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক শোভার নির্যাস উপভোগ করে, ভিন্ন জীবনধারা আর সংস্কৃতির জ্ঞান লাভ করে আর বিশুদ্ধ জলবায়ু সেবন করে মনটাকে তরতাজা করে দেশে ফিরবি। আর আমাকে কিনা এই গরম, যানজট, ধুলোবালিতে ছেয়ে যাওয়া ঢাকা শহরে পচে মরতে হচ্ছে! হ্যাঁ! সায়েমের প্রতি আমার হিংসার এই একটাই কারণ। সেটা হচ্ছে, ভ্রমণ। সায়েমের মত আমারও দেশ বিদেশ ভ্রমণের শখ। শুধু শখ বললে ভুল হবে, সেটা আমার নেশা; স্বপ্নও বলা যায়। সায়েমের মত আমিও স্বপ্ন দেখি একজন পর্যটক হবার। স্বপ্ন দেখি, পৃথিবীর পথে প্রান্তরে চড়ে বেড়াবার । নানান দেশের নানান সংস্কৃতির মানুষের সাথে মিশে যাওয়ার । সঙ্গে থাকবে একটা ক্যামেরা আর আমার প্রিয় অ্যাকুইস্টিক গিটার। সেই ক্যামেরায় বন্দী করে রাখব আমার পছন্দের স্থান আর প্রিয় মুহুর্তগুলোকে। গিটার বাজিয়ে গান শোনাব দেশ বিদেশের ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েদের। কিন্তু সেটা এখন পর্যন্ত স্বপ্নই থেকে গেলো। সায়েমের মত স্বপ্নটাকে আমি বাস্তবে রূপ দিতে পারছি না। আমার দৌড় কক্সবাজার কি বান্দরবান পর্যন্তই। তাও সেটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ট্যুর মারফৎ। নিজ দেশের গন্ডি পেরোনোর সাধ্য এখনও আমার হয়ে উঠেনি। কারণ, সায়েমের মত বিত্তশালী পরিবারের সন্তান আমি নই। আমার জন্ম একটি খাস মধ্যবিত্ত পরিবারে। এদেশের আর দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতই “সাধ আছে, কিন্তু সাধ্য নেই” নীতির উপর ভর করেই চলছে আমার পরিবার। যে পরিবারে মাসের শেষ দিনগুলোতে বাবার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। ছেলেমেয়েরা তাদের শখ আহ্লাদের কথা মুখ ফুটে তাদের বাবার কাছে বলতে পারে না। মায়েরা সংসারের জন্য তাদের সমস্ত আরাম আয়েশ বিসর্জন দেন। আজকের দিনে সেরকম একটি পরিবারের সন্তান হয়ে “পর্যটক” হবার স্বপ্নটা কেবল স্বপ্নই নয়, দুঃস্বপ্নও বটে!
ছোটবেলা থেকেই নানান জায়গায় ছুটে বেড়ানোর বদঅভ্যাস(!) ছিল আমার। প্রায়ই স্কুল ফাঁকি দিয়ে বেকবেঞ্চার বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে বেড়িয়ে পড়তাম। কখনো চলে যেতাম, মাইজখাপন ইউনিয়নের কাচারীপাড়া গ্রামের ভেতর বয়ে যাওয়া ফুলেশ্বর নদীর তীরে, কখনো বা কাদিরজঙ্গল ইউনিয়নের জঙ্গলবাড়িতে। স্কুল জীবনের সেই ঘুরে বেড়ানোর বদঅভ্যাসটাই আমাকে পর্যটক হবার জন্য অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবনেও সেই ভ্রমনের পাগলামিটা দূর হয়নি। এখনও সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ি এখানে সেখানে। আমার একগুঁয়ে বহির্মুখী স্বভাবের কারণে বাবা-মা সবসময়ই আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগেন। ছোটবেলায় তার জন্য কম শাসন হজম করতে হয়নি আমাকে। শাসনের সঙ্গে সঙ্গে চলত মোটিভেশনাল স্পীচ। “আগে মন দিয়ে লেখাপড়া কর। ভালো রেজাল্ট করে এস্টাবলিস্ট হও। তারপর তুমি তোমার ইচ্ছামতো দেশ বিদেশ ভ্রমণ করতে পারবে।” শৈশব থেকেই এই আশ্বাসবাণীটা হোমিওপ্যাথি ওষুধের মত সকাল সন্ধ্যা আমাকে গেলানো হচ্ছে। আমিও গিলেই চলেছি। দেখি ভবিষ্যতে কি হয়!
তবে, শুধুমাত্র অনুপ্রেরণামূলক বাণী গিলেই দমে যাওয়ার পাত্র আমি নই। শৈশবের মত এখন হয়তো এতোটা দুরন্তপনায় মেতে উঠতে পারি না। তবে আমার ভ্রমন কিন্তু থেমে নেই। বরং দিন দিন আমার ভ্রমণের সীমা পরিসীমা বেড়েই চলেছে। আমি আমার মত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে দুরন্তবেগে ছুটোছুটি করে চলেছি। সায়েমের চেয়েও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জায়গায় পদচারণ করি। ফ্রম সুমাত্রা টু সুমেরু। প্রশ্ন জাগতে পারে, সেটা কি করে সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর সত্যজিৎ রায় তার অবিস্মরণীয় সৃষ্ট চরিত্র লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ুর মাধ্যমে দিয়ে গেছেন।
“কল্পনার দৌড় থাকলে শুধু প্লেনে কেন? রকেটে করে চাঁদে পর্যন্ত যাওয়া যায়”
জটায়ুর মত আমার কল্পনার দৌড়টাও নেহাৎ কম নয়। সৃষ্টিকর্তা আমাকে এই একটি জিনিস একেবারে ঢেলে দিয়েছেন, “কল্পনা শক্তি”। তুখোড় কল্পনাশক্তি আমার। সেই কল্পনাশক্তির জোরে আমি যখন তখন যেখানে খুশি সেখানে চলে যেতে পারি। দৈনন্দিন দায়িত্ব-কর্তব্যের ফাঁক-ফোকরে যখন গল্প-উপন্যাস কিংবা ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে বসি, তখন আমি হারিয়ে যাই গল্পের প্লটের ভেতর। প্রেক্ষাপট অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ যাইহোক না কেন আমি সেই প্রেক্ষাপটকে একেবারে জীবন্তরূপে দাঁড় করাতে পারি আমার কল্পনায় । প্লটের বর্ণনা অনুসারে আমার কল্পনার ক্যানভাসে জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠতে থাকে দেশ বিদেশের নানা শহরের অলিগলি, রাস্তাঘাট। আমি পরিষ্কার দেখতে পাই নিউইয়র্কের ব্যাস্ত রাস্তাঘাট কিংবা প্যারিসের সুপ্রশস্ত রাজপথ। কখনো তপ্ত সাহারায়, কখনো বৃষ্টিভেজা অ্যামাজান বনে আমি হেঁটে বেড়াই। চোখে পড়ে নানান রকমের চেনা অচেনা গাছপালা, ফুল-ফল। আমি তার রূপ, গন্ধ, স্বাদ অনুভব করতে পারি। কখনো কখনো গল্প উপন্যাসের কিংবদন্তীদের সাথেও আমার সাক্ষাৎ হয়ে যায়। লন্ডনের ২২১ বেকার স্ট্রীটে বিচরণ করতে যেয়ে সাক্ষাৎ হয়ে যায় গায়ে ওভারকোট জড়ানো, ছয়ফুট লম্বা, খাঁড়া নাকের শার্লক হোমসের সাথে। কখনোবা কোন নির্জন দ্বীপে মুখভর্তি দাঁড়ি-গোঁফওয়ালা রবিনসন ক্রুশোর সাথে আমার দেখা হয়ে যায়। কখনো কখনো আমি আমার বাংলাদেশটাকেই নিজের মত করে দেখি। সেই বাংলাদেশ অপরিকল্পনা আর অসচেতনার বলি নোংরা, ঘিঞ্জি, অর্ধমৃত বাংলাদেশ নয়। সেই বাংলাদেশ অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, অনেক বেশি স্নিগ্ধ, প্রাণবন্ত। সেখানে বুড়িগঙ্গায় বয়ে যায় নোংরা-আবর্জনাহীন স্বচ্ছ টলমলে পানি। আমার কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা নদী তার প্রাণ ফিরে পায়। সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র্য তার হারানো জৌলুশ ফিরে পায়। সুন্দরবন জুড়ে মোটাতাজা রয়েল বেঙ্গল টাইগাররা সুখে শান্তিতে বসবাস করে। প্রতিবেশি দেশের আগ্রাসন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত আমার কল্পনার সেই বাংলাদেশ।
কিন্তু, কল্পনায় কি সব হয়? কোনকিছু নিজ চোখে দেখার মাঝে যে তৃপ্তি সেই তৃপ্তি কি কল্পনায় দেখে পাওয়া যায় ? যায় না। যায় না বলেই কল্পনা থেকে যখন বাস্তবে ফিরে আসি, তখন মনটা আক্ষেপে ভরে যায়। বিষণ্ণ মনে ভাবতে থাকি, নিজের কথা, নিজের পরিবারের কথা। কি এমন ক্ষতি হয়ে যেতো, যদি আমার পরিবার আরেকটু ধনী হতো। কি এমন ক্ষতি হতো, যদি আমার পর্যটক হবার স্বপ্নটাকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতাম। অবুঝ শিশুর মত অভিমান জাগে সৃষ্টিকর্তার প্রতি। সেই অভিমান নিয়ে আমি ভাবতে থাকি ভ্রমণকাহিনীর লেখকদের কথা। ভ্রমণবিষয়ক অনুষ্ঠানের উপস্থাপকদের কথা। পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটোছুটি করে তারা তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারি করছে। হাজার রকমের সংস্কৃতির হাজার রকমের নির্যাসে নিজেদের হৃদয় পূর্ণ করছে। আহ! কতই না সুখে আছে তারা।
আমার বিছানার পাশে একটা ম্যাগাজিন পড়ে আছে। ভ্রমণবিষয়ক ম্যাগাজিন। নাম, “টেক্সাস হাইওয়েজ”। তবে জিনিসটি আমার নয়। আমার বন্ধু রবিনের। ভুলে আমার এখানে ম্যাগাজিনটি ফেলে চলে গেছে। আড্ডা দিতে এসে প্রায়ই সে ভুল করে এটা সেটা ফেলে রেখে চলে যায়। আমি ম্যাগাজিনটি হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলাম। ঝকঝকে রঙিন ছবিসহ ভ্রমণবিষয়ক নানান আর্টিকেল লেখা। ইচ্ছা করছে, এখনই পড়ে শেষ করে ফেলতে। কিন্তু এই মুর্হুতে সেটা সম্ভব নয়। ভার্সিটিতে যেতে হবে। ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরে এসে পড়া যাবে। আমি চটপট তৈরি হয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
ভার্সিটিতে চরম বিরক্তিকর একটা সময় কাটল । কোন ক্লাসেই মন বসাতে পারলাম না। টিচারদের লেকচার সব মাথার উপর দিয়ে গেলো। লেকচারের বিষয়বস্তু কিছুই বুঝিনি । বোঝার চেষ্টাও করিনি। ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিতে চাইলাম। আড্ডা জমলো না। এমনকি সিনেমার জোকারদের মত কাতুকুতু দিয়েও আড্ডা জমানো গেলো না। উল্টো বিরক্তি বাড়ল। অবশেষে আড্ডায় ইস্তফা দিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে বনানী বাসস্টপেজে এসে পৌঁছলাম। এখন কেবল বাসের জন্য অপেক্ষা।
ইতিমধ্যে আমার চোখের সামনে তিন তিনটা বাস চলে গেলো, কিন্তু প্রচন্ড ভিড়ের কারণে একটি বাসেও উঠতে পারলাম না। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো। এদিকে নীল আকাশকে ঢেকে দেওয়া মেঘের রং ক্রমেই গাঢ় হয়ে উঠছে। ক্ষণে ক্ষণে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম শব্দ জানান দিচ্ছে, যেকোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। সন্ধ্যা নেমে আসতে খুব বেশি দেরী নেই।বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে বাসে উঠতে না পারলে বেশ মুশকিলে পড়ে যাব। অবশেষে অনেক কষ্টে, ঠেলেঠুলে একটা বাসে উঠতে পারলাম। মুড়ির টিন খ্যাত গুলিস্তান টু আজমপুরগামী তিন নাম্বার বাসটি যেভাবে যাত্রীবোঝাই হয়ে আছে, তাতে করে সিট খালি পাওয়ার প্রশ্নই আসে না। কাজেই চাপাচাপি করে দাঁড়িয়ে যেতে হচ্ছে।
কুড়িল বিশ্বরোডে আসতেই শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। বাসের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকায় বাইরের দৃশ্যটা সহজেই দেখতে পারলাম। বেশ জোরেসোরেই বৃষ্টি নেমেছে। অসুবিধা নেই, সামনের স্টপেজেই আমি নেমে যাব। বাস থেকে নেমে কোনমতে একটা চায়ের দোকান বা শপিং মলে আশ্রয় নিতে পারলেই হয়। তারপর না হয় বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। নিকুঞ্জ-২ এ বাস থামতেই আমি দ্রুত বাস থেকে নেমে পড়লাম। তারপর এক দৌড়ে চলে গেলাম রাজউক ট্রেড সেন্টারের পার্কিং লটে। ততক্ষণে আমার শরীরের একাংশ ভিজে গেছে। আমি পাত্তা দিলাম না। এসবে আমার অভ্যাস আছে। আমি পার্কিং লটে পোঁছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। সেখানে আমার মত আরও অনেক হতভাগাই বৃষ্টিতে আটকে গেছে। যাদের কপাল ভালো তারা খালি রিকশা পেয়ে যার যার গন্তব্যে চলে যাচ্ছে। আমি রিকশা খোঁজার চেষ্টা করলাম না। বরং পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে থেকে বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। অপেক্ষাটা মন্দ লাগছে না । বেশ ভালোই লাগছে। এভাবে বর্ষনমুখর সন্ধ্যা উপভোগ করার সুযোগ সবসময় হয় না। আমি একটা সিগারেট ধরালাম। সিগারেট টানতে টানতে বৃষ্টিমুখর শহরের পরিবেশটা উপভোগ করতে লাগলাম। সারাদিনের ধুলোবালি, তপ্ত রোদে জ্বলে যাওয়া শহরটা যেন বৃষ্টির স্পর্শ পেয়ে সতেজ হয়ে উঠেছে। ব্যাস্ত নাগরিক জীবনের ক্লান্তি, অবসাদ সব ধুয়ে মুছে শহরটা হয়ে গেছে ঝলমলে। বৃষ্টি হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার এমন এক দান, যা কিনা ইট-কাঠের ভিড়ে ছেয়ে যাওয়া এই যান্ত্রিক জীবন যাপনের শহরেও স্নিগ্ধতার পরশ বুলিয়ে দেয়। তবে সেই স্নিগ্ধতা সবাই উপভোগ করতে পারে না। সেটা করতে হলে নিজের মনটাকে তৈরী করে নিতে হয়।
ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলো। তবে সড়কবাতিগুলো তখনও জ্বলছে। শপিং মলে চালু করা হয়েছে জেনারেটর। বৃষ্টির বেগ এখনও থামেনি, বরং বেড়েছে। বাতাসের তোড়ে বৃষ্টির ফোটা তেরছা হয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে, আকাশ থেকে কেউ বিশাল একটা স্প্রে মেশিন দিয়ে পানি ছিটিয়ে শহরটাকে ধুয়ে দিচ্ছে। হেডলাইটের আলোতে অন্ধকার ভেদ করে শা শা শব্দে ছুটে চলছে গাড়ি। শহরের সড়কের দু’ধারের অসংখ্য দোকানপাটে বৃষ্টিতে আটকে পড়া লোকজনের ভিড়। রাস্তাঘাটে মানুষজনের চলাফেরা নেই বললেই চলে। সময় আর জীবনের তাগিদে কেউ কেউ রিকশায় করে কিংবা ছাতা মাথায় নিয়ে রাস্তায় বেড়িয়েছে। বর্ষনমুখর শহরের চিরচেনা দৃশ্য। বহু বছর আগে হয়তো এমনই কোন এক বর্ষনমুখর সন্ধ্যায় রবিঠাকুর লিখেছিলেন,
“আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, গেলো রে দিন বয়ে
বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়েরয়ে
একলা বসে ঘরের কোনে কী যে ভাবি আপন মনে
সজল হাওয়া যূথীর বনে কি যায় কয়ে”


হঠাৎ করেই আমার দৃষ্টি পড়ল পার্কিং লটের একদম ডানদিকের কোনায়। খানিকটা চমকে উঠলাম। আমার দৃষ্টি আটকে রইল একটি মেয়ের দিকে। মেয়েটি মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। হ্যাংলা পাতলা স্বাস্থ্য, গড়পড়তা উচ্চতার তুলনায় কিছুটা খাটো, পরনে সাদা শার্টের উপর কালো ব্লেজার, কালো প্যান্ট। বয়সে আমার মতই তেইশ চব্বিশ বছরের মত হবে হয়তো। মেয়েটি আমাদের দেশের নয়, বিদেশিনী। তবে সাদা চামড়ার ইউরোপিয়ান বা আমেরিকান নয়; এশিয়ান। কোন দেশী হতে পারে? চাইনীজ, জাপানীজ নাকি কোরিয়ান? নিশ্চিত হতে না পারলেও তাকে আমার চাইনীজ বলেই মনে হলো। মেয়েটি দেখতে বেশ; সুশ্রী চেহারা। কালো পোশাকে তাকে মানিয়েছে বেশ। আমার দৃষ্টিতে অবশ্য চাইনীজ মেয়েদের সব ধরনের পোশাকেই মানায়। ইউরোপ-আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ মেয়েরা শাড়ি পরলে অদ্ভুত দেখায়। বাঙালি মেয়েরা ওয়েস্টার্ন ফরমাল পোশাক পরলে মনে হয়, কোথায় যেন একটা ঘাটতি আছে। পুরোপুরি মানাচ্ছে না। কিন্তু শুকনা পাতলা চাইনীজ মেয়েগুলো দক্ষিন এশিয়ান বা ওয়েস্টার্ন যে পোশাকই পরুক না কেন, দেখতে বেশ ভালোই লাগে। এই ভালো লাগাটা কি সার্বজনীন নাকি কেবল আমার ব্যাক্তিগত পছন্দ আমি জানি না। তবে যাইহোক না কেন, এই মেয়েটিকে আমার একটু বেশিই ভালো লাগছে। ইচ্ছা করছে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে। কিন্তু মেয়েদের দিকে একটানা তাকিয়ে থাকতে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না বলে আমি মেয়েটির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। কিন্তু চোখ ফিরিয়ে নিতে কেন যেন মনটা সায় দিচ্ছে না। বৃষ্টি দেখায়ও মন দিতে পারছি না। অথচ একটু আগেও তো বৃষ্টিস্নাত শহরের সৌন্দর্য্য মন ভরে উপভোগ করছিলাম, এখন সেভাবে উপভোগ করতে পারছি না। বারবার মনটা কেবল আমার অদূরে দাঁড়ানো নিঃসঙ্গ সেই বিদেশিনীর দিকে চলে যাচ্ছে। একটা দূর্বার আকর্ষন যেন আমাকে মেয়েটির কাছাকাছি নিয়ে চাইছে। কিন্তু সেই আকর্ষনটা কিসের? সুন্দর চেহারা? নাকি অন্যকিছু? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলাম। মনের টানেই হোক কিংবা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্যই হোক, আমি তার দিকে আবার তাকালাম।
একটু আগে আমি ঠিক যেভাবে দু চোখ ভরে বৃষ্টি দেখছিলাম, মেয়েটিকেও দেখলাম ঠিক একই ভঙ্গীতে বৃষ্টি দেখছে। সে বোধহয় বৃষ্টি খুব ভালোবাসে। তার দেশে যখন ঝুম বৃষ্টি নামে, তখনও বোধহয় ঠিক এভাবেই মনপ্রাণ ভরে বৃষ্টির সৌন্দর্য্য উপভোগ করে। মেয়েটি বৃষ্টি দেখায় এতোটাই মগ্ন যে, বৃষ্টির ছাঁট চোখে, মুখে এসে পড়লেও তার মুখভঙ্গীর কোন পরিবর্তন দেখা গেলো না। মাঝে মাঝে দমকা বাতাসের ঝাপটা এসে তার খোলা চুলকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। সেদিকেও তার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। তার মুখভঙ্গি থেকে শুরু করে বৃষ্টিমুখর পরিবেশ, অর্থাৎ পুরো দৃশ্যটা আমার কাছে ছবির মত লাগছে। মনে হচ্ছে, কোন চৈনিক শিল্পী তার সুনিপুন দক্ষ তুলির আঁচড়ে এই বৃষ্টিস্নাত শহরে আটকে পড়া কোন মেয়ের ছবি এঁকেছে।
“এমন দিনে তারে বলা যায়,
এমন ঘনঘোর বরিষায়”
রবি ঠাকুরের এই চরণ দু’টি মনে পড়ছে। তার মত আমারও ইচ্ছা করছে মেয়েটিকে কিছু বলতে । কিন্তু কি বলব? কি বলা যায় তাকে? যেচে গিয়ে কিছু বলতে যাওয়াটা কি ভালো হবে? না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত চেহারার এক অজানা, অচেনা তরুণের যেচে কথা বলতে আসাটা বিদেশী মেয়েটি ভালোভাবে নাও নিতে পারে। ভয় পেতে পারে। নাক চ্যাপ্টা, ছোট চোখের পূর্ব এশিয়ান মানুষগুলো আদব-কায়দার ব্যাপারে খুব রক্ষণশীল হয়।
আমি মনে মনে মেয়েটির একটি নাম দিলাম। লিয়াং। কাছ থেকে দেখব বলে আমি খুব ধীরে ধীরে লিয়াং এর পাশে এসে দাঁড়ালাম। বৃষ্টি দেখায় সে এতোটাই মগ্ন যে আমার উপস্থিতি সে টের পেলো না। তার ছোট ছোট জ্বলজ্বলে চোখ দুটো তাকিয়ে আছে বর্ষনমুখর শহরের রাজপথের দিকে। পাতলা ঠোঁটের কোনায় মৃদু হাসি। বর্ষনমুখর সন্ধ্যার সৌন্দর্যের ভেতর ডুবে গেছে সে। বৃষ্টি দেখতে দেখতে হয়তো ভাবছে তার খুব প্রিয় কোন মুহুর্তের কথা, তার প্রিয়জনের কথা কিংবা শৈশবের কোন সুখস্মৃতি মনে করছে। কি এক অপার্থিব আনন্দে তার চোখে, মুখে এক স্নিগ্ধ আভা ফুটে উঠেছে। সেই শান্ত, কোমল আভায় উজ্জ্বল মুখখানি দেখতে কি যে ভালো লাগছে তা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়। রবি ঠাকুরের মত গোটা বিশেক কবিতা লিখে ফেলা যায়। ইশ! আজকের বৃষ্টি যদি শেষ না হতো! সারারাত যদি তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম!
আমি লিয়াং এর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। জীবনে এই প্রথম কোন মেয়ের দিকে একটানা এভাবে তাকিয়ে থাকা। তার স্নিগ্ধ হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছি। আমার চারপাশটা ক্রমেই বদলে যেতে শুরু করেছে। গাড়িঘোড়ার আওয়াজ ক্রমেই নিচু হয়ে আসছে। সেই সঙ্গে কমছে বৃষ্টির বেগ। পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি আর মানুষগুলো ধীরে ধীরে উধাও হয়ে যাচ্ছে। একটা সময় আমার পাশে দাঁড়ানো লিয়াংও উধাও হয়ে গেলো।

 


আমি হেঁটে চলেছি আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা ধরে। আমার চারধারে চেনা অচেনা নানা রকম গাছপালা, রং বেরঙের লতাগুল্ম। তার সঙ্গে পাখির কিচিরমিচির শব্দ আর দূর থেকে ভেসে আসা আরহু নামক বাদ্যযন্ত্রের সুরেলা আওয়াজ মনটাকে মাতিয়ে তুলছে । আমি খানিকটা সামনে এগিয়ে বাঁক নিতেই পাহাড়ের উপর একটা ছোট আশ্রম দেখতে পেলাম । আশ্রমের মন্দিরটির নাম লিংইন টেম্পল। মন্দিরের দেওয়ালের রং আধুনিক হলেও তার গঠনশৈলী আর নকশা বেশ প্রাচীন। মন্দিরের জানালাগুলো অদ্ভুত আকৃতির; ষড়ভুজাকার। মন্দিরের বারান্দায় একটি ছোট চৈনিক শিশুকে দেখা যাচ্ছে। তার ন্যাড়া মাথা আর ঢিলেঢালা পোশাক দেখে বুঝতে পারলাম সে এই মন্দিরের ছাত্র। কালচে খয়েরি রঙের কাঠের রেলিঙে হাত রেখে উদাস দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে মলিন হয়ে যাওয়া এক বাঘের ভাস্কর্যের দিকে। বাঘের ভাস্কর্যের একটু দূরে বিশাল এক ড্রাগনের মাথার মুর্তি দেখা যাচ্ছে। ড্রাগনের মুখ থেকে অবিরাম পানি ঝরছে। এটি মূলত একটি পানির ফোয়ারা। প্রকৃতি আর কৃত্রিমতার অপুর্ব সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে ফোয়ারাটি। স্থানে স্থানে পাথর কেটে বানানো অদ্ভুত সব মূর্তি, চীনা লোককাহিনীর মাতাল, অলস এবং খামখেয়ালী সাধক জি গং এর ভাস্কর্য। এখানেই সমাধিস্থ করা হয়েছিল তাকে। একটা বিশাল পাথরের কেটলিও দেখা যাচ্ছে। কেটলির নল থেকে চায়ের মত নিচে পড়ছে সরু পানির ধারা । যেন অদৃশ্য কোন মানুষ এক বিশাল কেটলি হাতে পানি ঢালতে ঢালতে বলছে, “ঢেলে দেই?” ভাবতেই খানিকটা হাসি পেলো। তবে ফোয়ারাটি যে কেবল দেখতে মনোমুগ্ধকর তা কিন্তু না। বরং এই ফোয়ারার পানি অত্যন্ত সুমিষ্ট, সুপেয়। খনিজ লবনে সমৃদ্ধ সুপেয় পানির জন্য এই হুপাং ফোয়ারার খ্যাতি আছে। যদিও আমি বৌদ্ধধর্মের অনুসারী না, কিন্তু এই মন্দিরের শান্ত পরিবেশ আর চারপাশের প্রকৃতির নম্রতা আমার হৃদয়ে প্রশান্তির হাওয়া বইয়ে দিল।
এতোক্ষণ এই টাইগার স্প্রিং অর্থাৎ হুপাং ফোয়ারার সামনে আমি ছিলাম একা। কিন্তু এই মুহুর্তে নিজেকে একা মনে হচ্ছে না। আমার ডানপাশে আরেকটি মানবসত্তার অস্তিত্ব টের পাচ্ছি। আমি মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকালাম। আমার খুব কাছাকাছি, একরকম গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে এক চৈনিক তরুণী। মেয়েটির নাম লিয়াং। তার পরনে গাঢ় বেগুনি রঙের চাইনীজ কিমোনো। সুন্দর করে খোঁপা করা চুলে তাকে একেবারে প্রাচীন যুগের চাইনীজ রাজকুমারীর মত লাগছে। লিয়াং আমার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে একটা হাসি দিল। হাসির জবাবে আমি কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। শুধু হা করে তাকিয়ে রইলাম। লিয়াং আমাকে তার সঙ্গে যাওয়ার ইশারা করল। আমিও সম্মোহিতের মত তার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। কোথায় যাচ্ছি জানি না। শুধু জানি যে আমরা উত্তর দিকে যাচ্ছি।
লিয়াং আমাকে নিয়ে গেলো একটি সুবিশাল লেকের তীরে। আমি লিয়াং এর পাশে দাঁড়িয়ে লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। লেকের তীরে চেরিফুল সহ অনেক অজানা ফুলের গাছগাছালি। এখানকার পরিবেশ হুপাং ফোয়ারার পরিবেশের মত এতোটা ছমছমে নয়, বরং অনেক বেশি খোলামেলা আর প্রশস্ত । তবে হুপাং ফোয়ারার মতই আশ্চর্য রকমের শান্ত এবং মনোরম। মনের গভীর থেকে সেই প্রশান্তি অনুভব করা যায়। লেকের ঢেউ খেলানো স্বচ্ছ টলমলে পানির উপর সূর্যাস্তের লাল আলোর ছটা যেন পুরো লেকটিকে জ্বলন্ত অঙ্গারের মত লাল রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। ঐ সুদূর দিগন্ত রেখায় পাহাড়ের সাড়ি লেকের সীমা রেখার জানান দিচ্ছে। লেকের উপর বেশ দূরে একটা সেতু দেখা যাচ্ছে। সেতুর দু’পাশ মসৃণ এবং পানির উপর সমান্তরাল, কেবল মাঝখানটা স্পীডব্রেকারের মত উঁচু হয়ে আছে। এটি ব্রোকেন ব্রিজ নামে পরিচিত। নামটি ব্রোকেন হলেও আদতে এটি ভাঙা নয়। লিয়াং এর কাছ থেকে জানতে পারলাম, এই ব্রীজের আসল সৌন্দর্য দেখা যায় শীতকালে। শীতকালে যখন ব্রিজটি বরফে ঢাকা পড়ে, তখন তাকে সত্যিই ব্রোকেন ব্রিজ বলে মনে হয়।
আমি জানি আমি কোথায় আছি। আমি আছি চীনের হাংঝৌ শহরের ওয়েস্ট লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে । যে লেকে ভ্রমণ করার স্বপ্ন আমি বহুকাল ধরে দেখে এসেছি। বহুবার আমি এখানে এসেছিও। কিন্তু আজকের মত ওয়েস্ট লেক আগে কখনো এতোটা আপন করে নেয়নি আমাকে। তার একমাত্র কারণ হচ্ছে, লিয়াং। এর আগে আমি যতবার আমি এখানে এসেছি, ততবার আমি ছিলাম নিঃসঙ্গ একা। আমার হাতটি ধরার মত কেউ ছিল না। কিন্তু আজ আমি একা নই। আজ আমি আমার ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে পেয়েছি লিয়াংকে। লিয়াংকে সঙ্গী হিসেবে পাওয়ার আনন্দটাই আমাকে ওয়েস্ট লেকের এতো কাছে নিয়ে আসছে। আমার হৃদয় থেকে বহুকালের জমানো দুঃখ, কষ্ট, হতাশার কালিমাগুলো যেন ওয়েস্ট লেকের স্বচ্ছ্ব পানিতে ধুয়ে মুছে যাচ্ছে। লিয়াং আলতো করে আমার হাত স্পর্শ করল। আমি চমকে উঠলাম। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শিহরণ বয়ে গেলো। এই স্পর্শ আমার চেনা। এটা ভালবাসার স্পর্শ। যে স্পর্শের জন্য প্রেমিক হৃদয় ব্যাকুল হয়ে থাকে চিরটাকাল। আমার আর ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না। ইচ্ছা করছে, লিয়াংএর পাশে থেকে জীবনের বাকিটা সময় এই লেকের তীরেই কাটিয়ে দেই।

হঠাৎ গাড়ির হর্নের বিকট আওয়াজে আমি কেঁপে উঠলাম। আমার কল্পনার জাল গেলো ছিন্ন হয়ে। কল্পনার সুদূর ওয়েস্টলেক থেকে ফিরে এলাম বাস্তবে। সেই চিরচেনা রাজউক ট্রেড সেন্টারের পার্কিং লটে। কোথায় সেই লিংইন টেম্পল, কোথায় হুপাই ফোয়ারা? কোথায় সেই ছোট্ট চাইনীজ শিশুটি? কোথায় ওয়েস্ট লেক? আমার চোখের সামনে থেকে মুহুর্তের মধ্যেই উধাও হয়ে গেলো হাংঝৌ শহরের সমস্ত চিহ্ন। শুধু থেকে গেলো তার অনুভূতিটুকু। বিষন্নতায় আমার মনটা ভরে গেলো। মনে হলো নিজের দেশের কথা। ওয়েস্টলেকের যে শান্ত, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ আমি দেখলাম, সেই পরিচ্ছন্নতা তো আমরাও আমাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে পারতাম। কিন্তু আমরা কি আদৌ তা করছি? আমরা কি আমাদের দেশের দৃষ্টিনন্দন স্থানগুলোর সৌন্দর্য বজায় রাখতে পারছি? যত্রতত্র ময়লা, আবর্জনা ফেলে কি দেশের সৌন্দর্যটুকু নষ্ট করছি না? কি অবস্থায় আছে আমাদের সাফারি পার্কের প্রাণীগুলো? কি অবস্থায় আছে ঢাকার বুডিগঙ্গা? সর্বত্রই শুধু অসচেতনা, অবহেলা, দূর্নীতি, রাজনীতি আর প্রতিবেশি দেশের ছল চাতুরী আর আগ্রাসন। সেসবের বলি হতে হচ্ছে আমাদের সুন্দরবনকেও। যে সুন্দরবন ছিল আমাদের গর্ব, যে সুন্দরবন বিশ্বের দরবারে আমাদের দেশকে উপস্থাপন করত; সেই সুন্দরবন দিন দিন তার আবেদন হারাচ্ছে। আবেদন হারাচ্ছে বান্দরবান, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন। বিশ্ব দরবারে নিজেদের উপস্থাপন করার আশায় আজ আমরা সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিজয়িনীদের দিকে তাকিয়ে থাকি। তাকিয়ে থাকি খেলাধূলার দিকে। কিন্তু বহির্বিশ্ব থেকে সুনাম অর্জনের জন্য তো আমাদের এসবের দরকার ছিল না। সুনাম অর্জনের জন্য যথেষ্ট উপাদান প্রকৃতিতেই ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা। সেই উপাদানগুলো আমরা নিজ হাতে নষ্ট করছি। আমাদেরই অবহেলা, অসচেতনার বলি হয়ে আবেদন হারাচ্ছে বাংলাদেশ। ভাবতে ভাবতে আমি লিয়াংএর দিকে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠলাম আমি। লিয়াং আমার দিকে তাকিয়ে আছে! তার ঠোঁটের কোনে সুক্ষ্ণ হাসির রেখা। কল্পনায় লিংইন টেম্পলের সামনে সে যে ভঙ্গীতে আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল, সেই একই ভঙ্গিতে হাসছে। নিজের চোখকে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। এটা কি আমার পাগলাটে মস্তিষ্কের কল্পনা? নাকি বাস্তব? আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বিস্ময়ে আমি এতোটাই নির্বাক হয়ে গিয়েছি যে, তার দিকে কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলাম। এমনকি তার হাসির জবাবে সৌজন্যমূলক পাল্টা হাসি দিতেও ভুলে গেলাম। ঠিক যেমনটা ঘটেছিল আমার কল্পনায়।
অবশেষে বৃষ্টির বেগ কমে আসল। রাস্তাঘাটে বেড়ে গেলো লোকজনের আনাগোনা। পার্কিং লটে অপেক্ষারত লোকজনের অপেক্ষার পালা শেষ হলো। যে যার মত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে নেমে পড়ল রাস্তায়। লিয়াংও আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রাস্তায় নামল। তাকে যেতে দিতে ইচ্ছা করছে না। ইচ্ছা করছে তার হাতটি ধরে আরও কিছুটা সময় আমার পাশে থাকার অনুরোধ করতে। কিন্তু সেটা তো হওয়ার নয়। এটা তো আমার কল্পনার রাজ্য নয়, এটা বাস্তব। এখানে আমরা পরস্পরের কাছে স্রেফ অচেনা, অজানা ভিনদেশী মানুষ ছাড়া আর কিছুই নই। এখানে কেউ কারোর জন্য দায়বদ্ধ নয়। কিন্তু আবেগ তো আমার বাস্তবতার এই কঠিন সত্যকে মানতে পারছে না। সেই আবেগের টানেই আমি লিয়াং এর পিছু পিছু খানিকটা এগিয়ে গেলাম। লিয়াং চলে যাচ্ছে। আমার চোখের সামনে লিয়াং ধীরে ধীরে জনমানবের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে । চিরদিনের জন্য আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে লিয়াং । আর কোনদিন হয়তো দেখা হবে না তার সাথে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। খুব প্রিয় কিছু হারানোর বেদনা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। জীবনে প্রথমবার ভালোবাসা হারানোর পর যে কষ্ট পেয়েছিলাম, সেই একই কষ্ট আলপিনের মত খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমার হৃদয়টাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। কিন্তু কেন? একটা অচেনা, অজানা ভিনদেশি মেয়ের জন্য আমার এতো কষ্ট হচ্ছে কেন? নানান ঘাত প্রতিঘাতে জর্জরিত, পোড় খাওয়া এই পাথরের মত হৃদয়ে একটা অচেনা মানুষের জন্য এতোটা আবেগ জড়ো হবে কেন? এমনটা তো হওয়ার কথা না। তবে কি আমি কল্পনায় লিয়াংকে ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে পেয়ে বাস্তবে তাকে ভালোবেসে ফেলেছি?