ঢাকার ইতিহাস
- আপডেট সময় : ০২:৪৩:৫১ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪ ৭৯ বার পড়া হয়েছে
ঢাকার চারশ’ বছর উদযাপনে ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে গেছে আরও চারশ’ বছর ।ইতিহাস গ্রন্থের অনুপস্থিতি, লিখিত সূত্রের অপ্রতুলতা, যথাযথ গবেষণার অভাব আর প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোকে ইতিহাস বিনির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যবহার না করাতে আমাদের আজকের রাজধানী ঢাকার অতীত গৌরব অনেক ক্ষেত্রে মলিন হয়ে যাচ্ছে। অতি সাম্প্রতিককালে বাংলার তথা আমাদের রাজধানী ঢাকার ইতিহাস নিয়ে যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণভিত্তিক বাস্তবসম্মত গবেষণা করা হচ্ছে তাকে অনেকটা বৃদ্ধাঙুলি প্রদর্শন করে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণাকেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দাঁড় করাতে চেষ্টা করা হচ্ছে। এখানে বলা হচ্ছে সতের শতকের গোড়ার দিকে মোগলদের পূর্ববাংলা দখল ও ঢাকায় রাজধানী স্থাপনের মধ্য দিয়েই গৌরবের নগরী ঢাকার যাত্রা শুরু। ভ্রান্ত হলেও এই প্রচলিত ধারণাকে উপজীব্য ধরে সঠিক ইতিহাস বাদ দিয়ে রাজধানী ঢাকার চারশ’ বছর উদযাপনের এক উত্সবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। পরবর্তীকালে আমাদের দেশের মূল ধারার মধ্যযুগ ও ঢাকা বিষয়ক গবেষক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহ্য সচেতন নাগরিকরা এর বিরোধিতা করলে চাতুরির আশ্রয় নিয়ে সুন্দরভাবে বলা হয় ঢাকার চারশ’ বছর। বাস্তব ও বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের ক্ষেত্রে এই দৃশ্যায়ন ক্ষতির কারণ হলেও তা অনেক ক্ষেত্রে করপোরেটসহ নানা দিকে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। আর আমরা এখন একটু বোঝার চেষ্টা করি যদি এই করপোরেট দুনিয়ার সহায়তালাভের মানসে আমাদের ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে তা জাতির জন্য কতটা অপমানজনক। তবে এর দ্বারা আমরা পথ পেয়েছি মূল বাস্তবতা বোঝার, যার আলোকেই ঢাকার প্রাচীনত্বকে একটু খুটিয়ে দেখা। এটিই মূলত আমাদের ইতিহাসের মূল বাস্তবতার কাছাকাছি নিয়ে ইতিহাস ঐতিহ্য ধ্বংসের হটকারী সিদ্ধান্তকে প্রতিবাদ করার পথ দেখিয়েছে। সুলতানি শাসন পর্বের পূর্বে ঢাকার ইতিহাস ইতিহাস বিচার করতে গেলে আমরা দেখি ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দের দিকে ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ প্রথমত বাংলায় একজন স্বাধীন সুলতান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। আর তাঁর হাত ধরেই সোনারগাঁওয়ে শুরু হয় দুইশ’ বছরব্যাপী বাংলার স্বাধীন সালতানাতের যাত্রা, যা দিল্লির সালতানাত হতে ছিল পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন, এক কথায় বিদ্রোহী। এই সময়কাল থেকেই একটি ছোট্ট শহর হিসেবে ঢাকার অস্তিত্ব ইতিহাসের সূত্রে পাওয়া যায়, যা কালেক্রমে বিকশিত হয়ে আমাদের আজকের রাজধানী শহর এই যানযট, আবাসন সঙ্কট আর নানা সমস্যায় জর্জরিত হলেও সবার গর্বের ঢাকা। ইতিহাসের সূত্রের দিকে দৃষ্টি দিতে গেলে সতের শতকের শুরুতে অর্থাত্ ঢাকায় মোগল অধিকার প্রতিষ্ঠার পূর্বে বাহারিস্তান-ই-গায়েবীতে মির্জা নাথান ঢাকার যে অবস্থার বর্ণনা করেছেন তা অনেকটা এমন—বুড়িগঙ্গার পূর্ব তীরে প্রতিষ্ঠিত একটি সুন্দর নগরী ছিল, যা ছিল অনেক জাঁকজমকে পরিপূর্ণ। ইতিহাসকে ভিত্তি করে এর অবস্থান নির্ণয়ের চেষ্টা করা হলে বর্তমান বাবুবাজারের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বে কয়েক মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই সুন্দর নগরীটি, যাকে আমরা ঢাকা নামে চিনি। আমরা মুসলিম আগমনপূর্বে সেন আমলের কথা ভাবলে দেখি বর্তমান পুরনো ঢাকার অনেক স্থান-নাম হিন্দু নামে দীর্ঘকাল ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে, যা এখানে প্রাচীনকাল থেকেই হিন্দু বসতি ও বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে স্থানটির পরিচিতি প্রদান করে। ইতিহাস ও সাহিত্যিক সূত্রেও এমন প্রমাণ পাওয়া যায়। ঢাকা বিষয়ক অন্যতম চিন্তাবিদ ও ঢাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের গুণী ব্যক্তি হাকিম হাবিবুর রহমান উর্দু ভাষায় লেখা তাঁর ‘ঢাকা আজ সে পচ্চিশ বরাস প্যাহলে’ গ্রন্থে বলেছেন, বিক্রমপুর যখন সেন রাজাদের রাজধানী তখন থেকেই ঢাকার দক্ষিণাংশে হিন্দু বসতি গড়ে উঠতে শুরু করে যা প্রচলিত ধারার ইতিহাস চর্চাকারীদের চিন্তাধারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তত্কালীন সময়ের স্মৃতি হিসেবে আমরা বর্তমান রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকার নামকরণ লক্ষ্য করি। এসব অঞ্চলের নামকরণের কারণ অনুসন্ধানে ইতিহাস বিশ্লেষণ, প্রত্নতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ কিংবা জাতিতাত্ত্বিক অনুসন্ধান প্রভৃতি ঢাকার প্রকৃত প্রাচীনত্বের যে সূত্রের সন্ধান দেয় তা বহুল আলোচিত ঢাকার চারশ’ বছর পালনকারীদের উত্থাপিত দাবিকে একাংশে নাকচ করে দেয়। এক্ষেত্রে আমরা উদাহরণ হিসেবে লক্ষ্মীবাজার, বাংলাবাজার, সূত্রাপুর, জালুনগর, বানিয়ানগর, গোয়ালনগর, তাঁতীবাজার, সুতারনগর, কামারনগর, পাটুয়াটুলি, কুমারটুলি ইত্যাদি এলাকার নামকরণের কথা বলতে পারি। এই নামগুলো মোগল-পূর্ব যুগে হিন্দু নিয়ন্ত্রিত নানা পেশাজীবীদের অবস্থানও নিশ্চিত করছে। রাজধানী সোনারগাঁওয়ের নিকটবর্তী হওয়ায় বাণিজ্য অঞ্চল বিস্তার করতে গিয়ে ঢাকার এই অঞ্চলে ক্রমে নাগরিক জীবনের বিস্তার ঘটে। সোনারগাঁও থেকে ঢাকার নগরায়ণের পথ প্রশস্ত হয় নদীপথের যোগাযোগ থাকায়। প্রাক-মোগল যুগে ঢাকার দক্ষিণ ও পূর্ব সীমা নির্ধারণ করে যথাক্রমে বুড়িগঙ্গা ও দোলাই খাল। সুনির্দিষ্ট তথ্যের অভাবে প্রাক-মোগল ঢাকার পশ্চিম সীমানা নির্ধারণ করা কঠিন। ১৬১০ সালে সুবাদার ইসলাম খাঁ বারো ভূঁইয়াদের পরাজিত করে ঢাকায় মোগল রাজধানী প্রতিষ্ঠা করার আগেই বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগার অঞ্চলে ‘ঢাকা দুর্গ’ নামে একটি দুর্গ ছিল। দুর্গের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা তীরের ঘাটটির নাম ছিল চণ্ডিঘাট। বাহারিস্তান-ই-গাইবীর বক্তব্য অনুযায়ী এই অংশে তখন দুটি অঞ্চলের বিকাশ ঘটে। এই চণ্ডিঘাটটিই পরে চকবাজার নামে পরিচিত হয়। দুর্গ থেকে চণ্ডিঘাট পর্যন্ত বাজারের বিস্তার ছিল। ঢাকা নগরীর বিস্তারের যুগে ইসলাম খান (১৬০৮-১৬১৩ খ্রি.) এখানে রাজধানী স্থাপন করেন এবং সম্রাটের নাম অনুসরণে এর নাম রাখেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ।
সুলতানি যুগে ঢাকা: ঢাকার প্রাশাসনিক গুরুত্বের প্রাচীনত্ব অনুসন্ধান করতে হলে সোনারগাঁওয়ের দিকেই ফিরে তাকাতে হয়। চলেবে—–